৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত কলাপাড়া মুক্ত দিবস
বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ রানা’র স্মৃতিচারণ

- আপডেট সময় : ০২:৩৯:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৫২৪ বার পড়া হয়েছে
৬ ডিসেম্বর, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত কলাপাড়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১’র এই দিনে কলাপাড়ার বীর সন্তানরা দেশ মাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাক সেনাদের পরাজিত করে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলাকে দখল মুক্ত করে। তাই এই দিনটি কলাপাড়ার আপামর জনসাধারণের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্মৃতি বিজরিত দিন।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এই বিজয়ের পিছনে রয়েছে ৩০ লাখ বাঙ্গালীর আত্মদান ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি। মুক্তিযুদ্ধে কলাপাড়া মুক্ত হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধকালীন কমান্ডার, কলাপাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রবীণ সদস্য, ঢাকা সাংবাদিক পরিবার কল্যান বহুমুখী সমবায় সমিতি লিঃ এর নির্বাচিত পরিচালক, সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল্লাহ রানা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ তথ্য প্রদান করেন।
তিনি স্মৃতি বিজড়িত ৫৩ বছর আগের কথা আবেগ তাড়িত হয়ে চলমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ব্যক্ত করে বলেন, ৩ ডিসেম্বর আমরা গলাচিপা থানা আক্রমন ও বিজয় অর্জনের পর সর্তক অবস্থায় বিশ্রামে থাকাকালীন ৪ ডিসেম্বর পড়ন্ত বিকালে প্রায় আরেকটি যুদ্ধাবস্থার মুখোমুখি হই। পটুয়াখালীর দিক থেকে গানবোর্ট সাদৃশ্য একটি জাহাজ পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে গলাচিপার দিকে আসতে থাকে। নদীর পাড়ের বাংকারগুলোয় আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেই। জাহাজটি কাছাকাছি এসেও যখন কোন রকম ফায়ার করছেনা, তখন লক্ষ্য করি জাহাজে পাকিস্তানী পতাকা ছাড়াও “ইউএস” লেখা নীল রংয়ের জাতিসংঘের পতাকাও রয়েছে। জাহাজটির নাম “ভাট্রি”। বাংকারের একেবারে কাছে নদীর কোলঘেঁষে এসে জাহাজের গতি একেবারেই কমিয়ে দেয়া হয়। আমরা কোন গুলি না ছুড়ে দরাজকন্ঠে জানতে চাই “তোমরা কারা”? নোয়াখালীর বৃদ্ধ নাবিক বলে ওঠে, “আমরা জাতিসংঘের এবং এতে নিরস্ত্র ৮/১০ জন থাইল্যান্ডের নাগরিক রয়েছেন। তারা পর্যবেক্ষণে এসেছেন। ওদেরকে সারেন্ডার করিয়ে গলাচিপা থানার সিও (ডেভ.) এর কাছে সোপর্দ করে “ভাট্রি”-কে ক্যাপচার করে নিই।
৪ তারিখ রাতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমান শওকত (জাসদ ইনু কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি) সিদ্ধান্ত নেন যে, এই জাহাজে চড়েই পটুয়াখালী আক্রমনে যাওয়া হবে। বেকে বসি আমরা, ভারতের উত্তর প্রদেশে গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত কলাপাড়ার ৬ জন বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের (বিএলএফ) মুক্তিযোদ্ধা। আমি জোড়ালোভাবে যুক্তি দেখাই যে, পেছনে অর্থাৎ কলাপাড়ায় শত্রু রেখে সম্মুখে এগোলে গেরিলাযুদ্ধের পরিপন্থী। এতে মোক্ষম কাজ হয়। অনেক দেন দরবারের পর সিদ্ধান্ত হয়, ৫ ডিসেম্বর রবিবার সন্ধায় কলাপাড়া থানা আক্রমন করা হবে। আক্রমন পরিচালনাকারী নিযুক্ত করা হয় আমাকে। “ভাট্টি” ও আরেকটি ড্রেজার বাহক নিয়ে ৫২জন মুক্তিযোদ্ধা কলাপাড়ার উদ্দেশ্যে গলাচিপা ত্যাগ করি। সন্ধ্যানাগাদ আমি জাহাজ দুটি আমার বাড়ী ইটবাড়িয়ায় ভেড়াই। উদ্দেশ্য, কলাপাড়ার পরিস্থিতি ও শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া। কুদ্দুস নামে এক সহসী মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় আমার বাড়ী যাই। বাড়ি গিয়ে শুনতে পাই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চরমপত্র কেবল শুরু হয়েছে। এক আত্মীয় বলে যে, সেনাবাহীনীতে কর্মরত আমার দুই সহোদর ভাই বাড়িতে অবস্থান করছেন। যুদ্ধের কৌশল আমি ততক্ষণে পরিবর্তন করে ফেলি। দুই ভাইকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পোষাক পরিহিত অবস্থায় মেশিনগানসহ ভাট্টিকে পাকিস্তানী পতাকা উড্ডীয়ন করে উঠিয়ে দেই। মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি ভাগে বিভক্ত করে এক দলে আমি নুরুল হুদা ইউপি ট্রেড রেজাউল করিম বিশ্বাস, নাজমুল হুদা ও কামাল পারভেজ (চলচিত্র প্রযোজক) সহ ২৩ জন যারা থানার পিছন থেকে সরাসরি আক্রমন করবো এবং অন্য দল ইউপি ট্রেন্ড শাহআলম তালুকদার, হাবিবুর রহমান শওকত, ইউপি ট্রেন্ড সাজ্জাত বিশ্বাস, আরিফুল রহমান মুকুল খানসহ বাকিরা ওয়াপদার কর্ণার থেকে কোনাকোনি আক্রমন করবে।
আমরা সকলেই পায়ে হেঁটে কলাপাড়ার কবরস্থানের উত্তর-পশ্চিম পাশে প্রথমে অবস্থান নেব এবং ওখান থেকে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যার যার অবস্থানে চলে যাব। ওপেনিং ফায়ার করব আমি (হাবিবুল্লাহ রানা)। সে দিনের পাসওয়ার্ড ছিল “কলাপাতা”। পাসওয়ার্ড হচ্ছে যুদ্ধাবস্থায় নিজেদের যোদ্ধাকে ওই শব্দ উচ্চরণে চেনা এবং ফায়ার ইউথড্রল সাইন। কমান্ডার বা নিযুক্ত যোদ্ধা সজোরে পাসওয়ার্ড উচ্চরণ করলে নিজেদের নির্ধারিত আস্তানায় ফিরে যাওয়া সেটি ছিল আমারই দায়িত্বে। ওদিকে ভাট্রির প্রতি নির্দেশ ছিল, আমাদের মার্চ করার অধাঘন্টা পর ইটবাড়িয়া থেকে কলাপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। থানার পিছনের খালপাড় হয়ে পজিশনে যাবার প্রাককালে আমার দলটি বিপাকে পড়ে। কথাছিল কাঠের পুলটির উপর দিয়ে আমরা আমাদের পজিশনে যাব এবং যেহেতু তখন ভাটা ছিল, শাহআলমের দলটি খাল পার হয়ে তারা ওয়াপদার পজিশনে যাবে। এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, আমরা ৬ জন যেহেতু কলাপাড়াবাসী সেহেতু দুই দলে আমরা ভাগাভাগি হয়েই ছিলাম। কাঠের পুলের দিকে যেতে না যেতেই রাস্তার উপরে আমি ও রেজাউল উঠে গেছি, অমনি রমিজ উদ্দিন বেপারীর বাসার ওখান থেকে দুইজন রাজাকার আমাদের দিকে টর্চ জ্বালিয়ে একটি থ্রিনট থ্রি রাইফেল তাক করে ‘কারা’ পেট্রোল? বলে চেচিয়ে ওঠে। টর্চের স্পষ্ট আলোয়ে আমাদেকে তাৎক্ষনিক রাজাকাররা যেমনি দেখতে পাচ্ছিল, আমরাও তাদের রাইফেলের নল দেখতে পাচ্ছিলাম। ওই রাইফেলের ট্রিগেটে চাপ পড়লেই আমাদের নির্ঘাত মৃত্যু হতো। কিন্তু পেছন থেকে কামাল পারভেজ রাজাকারদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়লে আমরা বেঁচে যাই। ততক্ষনে আমরা লইং পজিশনে চলে গেছি। নিয়ম অনুযায়ী কামাল পারভেজের ফায়ার করাটা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী সিদ্ধ ছিলনা। যে যাই হউক ওয়াবদার ওখান থেকে শুরু হয়ে যায় গুলি বর্ষণ। থানার ছাদ থেকে ও নিচে বাংকার থেকে পাল্টা গুলি শুরু হয় মিনিট পনের পর থেকে। এ সময় পূর্বাকাশে চন্দ্রের দেখা মেলে। ঘড়িতে চোখ ফেলে দিখি রাত পোনে আটটা। সার্চ লাইটের প্রচন্ড আলো বিকিরণ করে “ভাট্টি” যখন থানার দক্ষিণ পাশে নদীতে অবস্থান নেয় তখন রাত নয়টা। ভাটার কারণে ওটি আটকা পরে গিয়েছিল। জোয়ার আসার পর তা ইটবাড়িয়া থেকে অবমুক্ত হয়। এই জাহাজে আমার দুই আর্মি সৈনিক ভাইকে দিয়ে যে যুদ্ধ প্লান করেছিলাম, সেটিও ভেস্তে যায়। আমরা আক্রমন করার কিছুক্ষণ আগে ভাট্টি আসবে এবং সার্চ লাইটের আলোর সামনে সেনা পোষাক পরিহিত অবস্থায় দাড়িয়ে আমার দুই ভাই আহম্মদ আলী ও আশ্রাফ আলী উর্দুতে চিৎকার করে সিদ্দিক বিহারীকে এক মালাই নৌকা গুলোতে চরে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের নিয়ে জাহাজে উঠতে বলবেন। জাহাজটি তখন নদীর মাঝবরাবর অবস্থান নেবে। সিদ্দিক বিহারীর প্রতি তাদের ওই নির্দেশের পরপরই আমি ফায়ার স্টার্ট করব। এতে ভয় পেয়ে ওরা জাহাজ মুখো হবে এবং এলএমজি’র ব্রাশ ফায়ারে আন্ধারমানিকের পানিতেই পাকহানাদার বাহিনীর দোসরদের কবর রচিত হবে। কিন্তু প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে জাহাজ থেকে থানার উপর সরাসরি আক্রমন চালানো হয়। শুরু হয় কলাপাড়া থানার দোতলা লাল বিল্ডিং এর দিকে মুক্তিযোদ্ধারে ত্রিমুখি আক্রমন। এক সময় লক্ষ করলাম, থানার ছাদ থেকে যে সব গুলি আমাদের দিকে আসছে, তা অনেক উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার গ্রুপের ফায়ার স্টপ করে আমি রাজাকার কমান্ডার সেরাজের নাম ধরে নিজের পরিচয় দিয়ে জয় বাংলা বলে সারেন্ডারের আহ্বান জানাই। থানার বাংকার থেকে রাজাকার সেরাজ কমান্ডার বলে উঠে, হাবিব ভাই, আমরা বিপদে আছি, ছাদের উপর থেকে গুলি থামানোর ব্যবস্থা করেন।
জীবনের প্রতি আরেকটি রিস্ক নিলাম। দুটি থার্টি ছিক্স এইচই হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে থানার সঙ্গে সংযোগকারী সরু রাস্তাটিকে আড়করে ক্রলিং দিয়ে থানার পিছনের টয়লেটে গিয়ে হাজির হই। শরীরের সর্বশক্তিদিয়ে একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারি থানার ছাদকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেটি ছাদে না গিয়ে নিচে রাজাকারের একটি বাংকারে পরে। বিকট শব্দে ব্লাস্ট হয়। ওখানে মনা নামের এক রাজাকারের মৃত্যু ঘটে অন্য দু’জন গুরুতর আহত হয়। অন্য গ্রেনেডটি পায়খানার মধ্যে রেখেছিলাম। খুজেঁ সেটি আর পাইনি। বিস্টার মধ্যে ডুবে গেছে। মল পরিবেষ্টিত হয়ে পজিশনে ফিরে এসে আবার গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ারের নির্দেশ দেই। এভাবে রাত আড়াইটা পর্যন্ত চলে গোলাগুলি। অতপরঃ কমান্ডার নুরুল হুদার নির্দেশে রাত পৌনে তিনটার দিকে ফায়ার উইথড্রোলের ঘোষণা দিয়ে সকলে সেই ইটবাড়িয়ার নদীর পাড়ে চলে যাই। ভাট্টিকে সংকেত দেয়ায় সেটিও যথা সময় ফিরে আসে। আমরা গলাচিপার উদ্দেশ্য পাড়ি জমাই। ৬ ডিসেম্বর ভোর বেলা পুলিশ ও রাজাকাররা তৎকালিন আওয়ামীলীগ নেতা ডাঃ আবুল কাশেম ও মোশারেফ হোসেন বিশ্বাস এর কাছে অস্ত্রসস্ত্র হস্থান্তর করেন।